রবিবার – ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ –  ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রবিবার – ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ –  ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কোরবানির মসলা: দাম কমেছে পত্রিকায়, বাস্তবে আগুন

ঈদুল আজহা সামনে রেখে চট্টগ্রামের মসলার বাজারে চলছে তথ্য ও বাস্তবতার এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। পত্রপত্রিকায় মসলার দাম কমার খবর ছড়ালেও নগরের বিভিন্ন খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। কিছু মসলার মূল্য কিছুটা কমলেও ভোক্তাদের আশার চেয়ে তা অনেকটাই কম, অন্যদিকে জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় কিছু মসলার দাম এখনও ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

বৃহস্পতিবার (২৯ মে) সরেজমিনে খাতুনগঞ্জ, অলংকার বাজার, কর্নেলহাট ও চকবাজার ঘুরে এমন তথ্য উঠে আসে। মসলার পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের তুলনায় পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ ও কিছু মসলা তুলনামূলক সস্তা হলেও এলাচ, দারুচিনি, জিরা, লবঙ্গের মতো মূল মসলাগুলোর দাম এখনও ‘আকাশে’।

কিছু কমেছে, অনেক কিছুই এখনও আগুন

খাতুনগঞ্জে পাইকারি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ টাকা কম। আদা ১১০ টাকায় (কমেছে ১৫০–২৯০ টাকা), রসুন ১৮০ টাকায় (৩৫ টাকা কম), শুকনা মরিচ ২৮০ টাকায় (১২০ টাকা কম), তেজপাতা ১৪০ টাকায় (১০ টাকা কম), লবঙ্গ ১,২৫০ টাকায় (৫০ টাকা কম), গোলমরিচ ১,২০০ টাকায় (প্রায় ১০০ টাকা কম), দারুচিনি ৫৫০ টাকায় (১০ টাকা কম), ধনিয়া ২০০ টাকায় (২০ টাকা কম) এবং জিরা ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ খুচরা ব্যবসায়ীর দাবি, এই দাম শুধু খাতুনগঞ্জ বা কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ। বাস্তবে তারা নিজেরা এসব মসলা আরও বেশি দামে কিনে আনতে বাধ্য হচ্ছেন।

এলাচের দামে এখনও আগুন

সবচেয়ে দৃষ্টিকটুভাবে চড়া দামের মধ্যে রয়েছে এলাচ। সাদা এলাচ কেজিপ্রতি ৩,৮০০ থেকে ৫,০০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা আগের চেয়ে ৪০০ টাকা কমলেও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কালো এলাচও এখনও কেজিপ্রতি ২,৬০০ টাকায় স্থির, যা সর্বসাধারণের জন্য বড় বোঝা।

খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ: “কম দামে কিনি না, বিক্রি করব কীভাবে?”

কর্ণেলহাটের একজন মসলা ব্যবসায়ী বলেন, “আপনারা পত্রিকায় পড়েন দাম কমেছে, কিন্তু আমাদের বাস্তবে কোথাও সেই দাম দেখা যায় না। আমরা যে দামে কিনছি, তাতে করে কম দামে বিক্রি করলে লোকসান ছাড়া কিছুই নয়।”

অলংকার বাজারের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা বাড়তি দামে কিনছি, তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি দামেই বিক্রি করছি। তাছাড়া পরিবহন খরচ, শ্রমিক মজুরি—সবকিছুই বেড়েছে। এখন কম দামে বিক্রি করা মানেই ক্ষতি সইতে হয়।”

কালোবাজারি ও গুদামজাতকারীদের দাপটে দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর ও কাস্টমস বিষয়ক সম্পাদক রাইসুল ইসলাম বলেন, “ব্যবসায়ীরাও সমস্যায় আছে। অনেক সময় আমদানির চেয়ে বিক্রির দাম কম হয়ে যাচ্ছে, কারণ বাজারে ভারসাম্য নেই। কালোবাজারিরা মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।”

তিনি আরও বলেন, “মজুতদাররা বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করছে। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় তারা এখনো সক্রিয়।”

ভোক্তা সংগঠনের আহ্বান: “সরকার কঠোর হোন, দোষীদের চিহ্নিত করুন”

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, “গত বছরের তুলনায় কিছু মসলার দাম কমেছে, কিন্তু সেটাকে ভোক্তাবান্ধব বলা যায় না। দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ—এই মসলাগুলোর ওপরই ভোক্তার চাপ বেশি, আর সেগুলোতেই দাম এখনও অনিয়ন্ত্রিত।” তিনি বলেন, “পাইকারেরা সত্য বলছে, না খুচরা বিক্রেতারা—তা যাচাই করা জরুরি। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরিকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। সরকারকে মাঠ পর্যায়ে কঠোর নজরদারি চালাতে হবে।”

ঈদের আগে যখন সাধারণ মানুষ পরিবারের জন্য সাধ্যমতো কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন মসলার বাজারে এমন পরিস্থিতি ভোক্তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি দর পত্রিকায় যে চিত্র তুলে ধরা হয়, তা বাস্তবে ভোক্তার ঝুলিতে কতটুকু পৌঁছায়—সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, দাম কমেছে পত্রিকায়, কিন্তু বাস্তবে এখনও মসলায় আছে আগুনের আঁচ।