ঋণে জর্জরিত অর্থনীতি, স্থবির বিনিয়োগ পরিবেশ আর লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে ঘোষিত হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এ বাজেট ঘিরে আশার পাশাপাশি সংশয়ের ভরও স্পষ্ট। অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, দীর্ঘদিনের ঋণনির্ভর বাজেট প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসার এখনই ছিল উপযুক্ত সময়, অথচ এবারের প্রস্তাবেও সেই পুরনো ছকের ব্যত্যয় হয়নি। রাজস্ব আয় বাড়াতে দৃশ্যমান কোনো নতুন উদ্যোগ নেই, আবার ঘাটতি মেটাতে বড় অঙ্কের ঋণ পরিকল্পনা—ফলে বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। ঋণের পাহাড়ে চেপে বসা অর্থনীতিকে ‘সুশাসন’ ও ‘পুনর্গঠন’-এর আশ্বাসে চাঙা করার চেষ্টা করা হলেও, বাজেট প্রস্তাবে নেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের দিশা কিংবা ঘাটতি মোকাবিলার বাস্তবসম্মত কৌশল। এমন এক সময়েই বাজেট এসেছে, যখন জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল পথে ফেরানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি’ অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারের ঘাড়ে প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে, যা আগামী অর্থবছরের মধ্যে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে বাজেটের আকার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়ানো হলেও তা ছিল মূলত ঋণনির্ভর। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এবং মৌলিক সংস্কারের পদক্ষেপ অনুপস্থিত থাকায় এটিকে ‘গতানুগতিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকে।
সংসদ না থাকায় সোমবার (২ জুন) বিকেলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে বাজেট বক্তব্য দেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। পরে রাতেই ‘অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে, প্রয়োজন হলে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে চলতি মাসের শেষে অধ্যাদেশ সংশোধন করা হতে পারে। বাজেট বক্তৃতার শুরুতে অর্থ উপদেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের এবং গত বছরের জুলাই-আগস্টের ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ‘প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি’ পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে লক্ষ্যপূরণে অনেক দূর এগিয়েছে এবং অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেট বক্তৃতার এই আশাবাদের প্রতিফলন বাজেটের বিস্তারিত প্রস্তাবে দেখা যায়নি। ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এই বাজেট চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের (৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম হলেও সংশোধিত বাজেটের (৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫.৫ শতাংশ এবং গত তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের বেশি থাকা মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৯৭ শতাংশ হতে পারে, যা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন (কোভিডকালীন অর্থবছর বাদ দিলে)। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে মানুষ এবং ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়েছে। নাজুক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হারও প্রায় ৩০ শতাংশ ছুঁয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা (এনবিআর ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি এবং কর-বহির্ভূত ও অন্যান্য ৪৬ হাজার কোটি টাকা)। বাজেট ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এই বিশাল ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা দেশের ব্যাংক খাত থেকে, ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে এবং বাকি ৯৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে কঠোর সংস্কারের প্রয়োজন ছিল, যা এই বাজেটে উপেক্ষিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব কমানোর সুযোগ থাকলেও বাজেটে মৌলিক বা কৌশলগত সংস্কার দেখা যাচ্ছে না।”
ব্যবসায়ী নেতা এবং ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, “বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যগুলো অর্জিত হবে না।উৎপাদন খাতের বড় শিল্পের কাঁচামালের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। সবকিছু আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী করা হয়েছে, যা শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।” তিনি টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল তুলার ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপের সমালোচনা করেন।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় অবশ্য বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে ‘নজিরবিহীন অপশাসন’ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কাঠামোগত সংস্কারে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, এ লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং তাদের প্রতিবেদনও জমা পড়েছে, যার আলোকে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। বাজেটে ৯৭টি পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, ৬০টি পণ্যের শুল্ক হ্রাস এবং ৬৬টি পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের আমদানি পর্যায়ে উৎসে কর কমানো এবং পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাবও রয়েছে। তবে, বিগত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামোর আদলে এবারের বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “সরকার এখন ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করছে। নিজেদের আয় বাড়াতে না পারলে সরকার এই ঋণচক্র থেকে বের হতে পারবে না।ব্যাংক খাত থেকে সরকারের বিপুল ঋণ বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।”
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করা হলেও আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এডিপি বরাদ্দ ১৪ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিচালন ও নন-এডিপি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে শুধু ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেট পুরনো ছকেই করা হয়েছে এবং এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় রয়েছে, যা বিগত বছরগুলোর মতোই অবাস্তবায়িত থেকে যেতে পারে।