যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি একাকিত্বে ভুগছেন। সম্প্রতি জনমত জরিপ সংস্থা গ্যালাপের প্রকাশিত এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের জেন জেড ও মিলেনিয়াল প্রজন্মের পুরুষের মধ্যে অন্তন্ত ২৫ শতাংশ নিজেদের একাকী মনে করেন। তুলনামূলকভাবে একই বয়সী তরুণীদের মধ্যে এই হার মাত্র ১৮ শতাংশ।
অর্থাৎ ৩৫ বছরের কম বয়সী প্রতি চারজন মার্কিন পুরুষের একজন নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা নিঃসঙ্গ মনে করছেন। ফ্রান্স, কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের মতো অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায়ও যুক্তরাষ্ট্রে এই হার বেশি।
তবে শুধু যে মার্কিন তরুণ পুরুষেরাই যে নিঃসঙ্গতা অনুভব করছেন এমন নয়। বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়েই এই সমস্যার ধরন অনেকটাই মিলছে। গ্যালাপ ও ফরচুন ওয়েল-এর যৌথ প্রতিবেদন বলছে, তুরস্ক, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড এবং কানাডার মতো দেশেও প্রতি পাঁচজন তরুণ পুরুষের একজন নিজেকে একাকী মনে করেন।
এই যৌথ গবেষণা নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব বয়েজ অ্যান্ড গার্লস লাইভস’-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও ‘হাউ টু রেইজ আ বয়: দ্য পাওয়ার অব কানেকশন টু বিল্ড গুড মেন’ বইয়ের লেখক মনোবিজ্ঞানী মাইকেল রাইখার্ট ফরচুন ওয়েলকে বলেন, ‘পুরুষ ও ছেলেদের জীবনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক চাপসহ নানা কারণ আজ একাকিত্ব রূপে দেখা দিচ্ছে।’
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন আজকের প্রজন্মের তরুণ পুরুষেরা বাইরের জগৎ থেকে নিজেদের এত বিচ্ছিন্ন অনুভব করছেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে বর্তমান সময়ের তরুণ পুরুষের মধ্যে এমন একাকিত্ব তৈরি হচ্ছে।
নিউইয়র্ক নগরের মনোচিকিৎসক জাস্টিন ইয়ং ফরচুন ওয়েল-কে বলেন, ‘তরুণেরা ক্রমেই বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তাঁরা ভিডিও গেম ও পর্নোগ্রাফির মতো কিছু বিষাক্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। এমন অভ্যাস স্বল্প মেয়াদে ডোপামিনের আনন্দ দিলেও বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’
রাইখার্ট বলেন, ‘সমস্যা হলো, যখন তাঁরা নিজেদের কম গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তখন নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফেলেন। তাঁরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করেন। তাঁরা ভাবেন, এই পৃথিবী তাদের দুর্বল অংশটা চায় না…আর মাত্র চার বছর বয়স থেকেই এমন প্রবণতা শুরু হয়।’
বিশ্বজুড়ে একাকিত্ব এখন শুধু মানসিক নয় বরং একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি জানিয়েছে, প্রতিদিন ১৫টি সিগারেট শরীরের ওপর যেমন প্রভাব ফেলে, একাকিত্ব বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটাও স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক ততটাই ক্ষতিকর।
আফ্রিকান ইউনিয়নের ইয়ুথ এনভয় চিদো এমপেম্বা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘একাকিত্ব এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয় নয়। সীমানা ছাড়িয়ে এটি এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এটা মানুষের স্বাস্থ্য, কল্যাণ ও সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থিসহ বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘যেভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা হৃদ্রোগের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা করা হয়, তেমনই গুরুত্ব দিয়ে একাকিত্বের সংকটকে মোকাবিলা করতে হবে।
মার্কিন সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একাকিত্ব ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক প্রভাব মাথায় রেখেই আমাদের উচিত সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা। এ খাতে আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে যেমনটা আমরা তামাক ব্যবহার, স্থূলতা বা আসক্তিজনিত সংকট মোকাবিলায় করে থাকি।’
সূত্র: নিউইয়র্ক পোস্ট