বৃহস্পতিবার – ৭ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ –  ২৩শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বৃহস্পতিবার – ৭ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ –  ২৩শে শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ট্রাম্প প্রশাসন থেকে সরে দাঁড়ালেন মাস্ক, নেপথ্যে কী?

কয়েক মাস ধরে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ট্রাম্প প্রশাসনের ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি (ডোউজ)-এর বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন।

সম্প্রতি তিনি সেই পদ থেকে সরে  ব্যবসায়িক জগতে ফিরে এসেছেন। মাস্কের এই পদক্ষেপ ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে ।

মাস্কের ওয়াশিংটন যাত্রার পেছনের কারণ

এলন মাস্ক সাধারণত নিজেকে একজন ব্যবসায়িক নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। যিনি বৈদ্যুতিক গাড়ি, মহাকাশ গবেষণা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন। যদিও তিনি তার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফর এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে কাজকে তার ব্যবসার একটি অংশ হিসেবে দেখেছিলেন। বিশেষ করে, মাস্কের বিভিন্ন কোম্পানির সরকারি নিয়ন্ত্রণ, অর্থায়ন ও চুক্তির বিষয়গুলোতে মাস্কের সরাসরি প্রভাব ফেলার ইচ্ছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

ডোউজ বা ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি -এর উদ্দেশ্য ছিল সরকারি ব্যয় কমানো এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা। মাস্কের মতো একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এ কাজে যুক্ত হওয়ার ফলে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবেন। মাস্ক নিজেও প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য কাজ করার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানে অবদান রাখতে চান।

ডৌউজ-এ মাস্কের অবদান ও চ্যালেঞ্জ

মাস্ক ডৌউজ -এ চার মাস কর্মরত ছিলেন এবং এই সময় সরকারি ব্যয় হ্রাসে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নেন। এর মধ্যে ছিল প্রায় ১০,০০০ সরকারি কর্মচারি ছাঁটাই, বাজেট হ্রাস এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের পর্যালোচনা।

ডৌউজ দাবি করেছে যে, মাস্কের উদ্যোগে তারা প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করেছে। যদিও টার্গেট ছিল প্রাথমিকভাবে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সঞ্চয়, যা পরবর্তীতে পূরণ হয়নি।

বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, মাস্কের পদক্ষেপগুলো সরকারি কর্মীদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি করে এবং কিছু ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব সৃষ্টি হয়। মাস্কের আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক ধারণা সবসময় সরকারি ব্যবস্থাপনার সাথে মানানসই নাও হতে পারে বলে মনে করা হয়েছে।  ফলে তার কাজের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।

বিদায় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

অবশেষে, মাস্ক তার এই পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। হোয়াইট হাউসে একটি আনুষ্ঠানিক বিদায়ী অনুষ্ঠানে ট্রাম্প তাকে ‘গোল্ডেন কি’ উপহার দেন এবং তার অবদানের প্রশংসা করেন। মাস্ক জানিয়েছেন, যদিও তিনি অফিসিয়ালভাবে পদত্যাগ করছেন। তবে তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসেবে যুক্ত থাকবেন।

মাস্ক সম্প্রতি ট্রাম্পের একটি নতুন আইন ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন, যা ডৌউজ -এর লক্ষ্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক। এর ফলে মনে হচ্ছে, মাস্কের প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া যথেষ্ট কঠিন।

ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল কি? 

‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ হলো একটি মার্কিন সরকারি আইন প্রস্তাব যা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রকল্পের বাজেট একত্রিত করে, প্রশাসনিক খরচ কমিয়ে কর্মক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য তৈরি। এ বিলের মূল উদ্দেশ্য হলো সরকারি ব্যয় হ্রাস এবং প্রশাসনিক কাঠামোর সহজীকরণ করে আরও কার্যকরি একটি সরকার গঠন করা।

ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল বনাম ডৌউজ

ডৌউজ বা ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি -এর লক্ষ্য ছিল সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো এবং সরকারি কাজের ধরণ আধুনিকায়ন করা। এলন মাস্ক, ডৌউজ’র উপদেষ্টা হিসেবে, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে কাজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু, ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ সেদিক থেকে ডৌউজ’র কিছু দিকের সঙ্গে যথেষ্ট সাংঘর্ষিক কারণ এই বিল কিছু ক্ষেত্রে পুরানো প্রশাসনিক কাঠামো রক্ষার চেষ্টা করে এবং প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তনের গতি কমিয়ে দেয়।

মাস্ক মনে করেন, এই বিল উদ্ভাবনী সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং ডৌউজ’র উদ্যোগে প্রস্তাবিত ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে।

ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল পাস হলে তার প্রভাব

সরকারের উপর: প্রশাসনিক কাঠামো কিছু পরিমাণে সহজ হলেও নতুন বিলের কারণে ডৌউজ’র প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কার প্রকল্পগুলো ব্যাহত হতে পারে। বাজেট কমানোর লক্ষ্য আংশিকভাবে আটকে যেতে পারে।

ব্যবসা ও উদ্যোক্তার উপর প্রভাব: যারা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চান, তাদের জন্য বিলটি বাধাস্বরূপ হতে পারে। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে।

সরকারি কর্মচারি: পুনর্গঠন ও ছাঁটাইয়ের কারণে অনিশ্চয়তা বাড়তে পারে তবে কিছু ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

সাধারণ জনগণ: সরকারি সেবার গুণগতমান ও কার্যকারিতা যদি বৃদ্ধি পায়, তারা উপকৃত হবেন কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা থাকলে সেবা পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন।

কাদের লাভ, কাদের ক্ষতি?

বিলটি সরকার ও নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণমূলক হাতিয়ার, যা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। তবে মাস্ক ও ডৌউজ’র মতো উদ্ভাবনী উদ্যোগে নিয়োজিত প্রযুক্তি নেতাদের জন্য এটি সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে।  সরকারি কর্মীদের মধ্যে পুনর্গঠন ও ছাঁটাইয়ে চাপ পড়তে পারে যা তাদের জন্য ক্ষতিকর।

অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদে যদি বিল সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে দেশের অর্থনীতি ও নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে উন্নতি আসতে পারে।

‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’—একটি ধারণা, আইন নয়

‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ মূলত একটি সরকারি সংস্কার প্রস্তাবনা, যা এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে পাশ হয়নি। এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ কিছু রাজনৈতিক নেতার ব্যবহারকৃত একটি ধারণা বা পরিকল্পনা, যার উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন সরকারি বিভাগ একত্রিত করে ব্যয় কমানো এবং সরকারি কাজের ধরণকে আরও কার্যকর ও সুশৃঙ্খল করা।

এটি একটি ভিশন বা নীতিমালা প্রস্তাবনা, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে সরকারে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বাড়িয়ে সরকারি খরচ কমানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যেখানে এলন মাস্কের মতো কিছু বিশেষজ্ঞ দিকনির্দেশনা দিয়ে কাজ করেছেন।

তবে এই প্রস্তাবনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। একপক্ষের কেউ মনে করেন- এটি জরুরি সংস্কার, যা সরকারের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাবে এবং নাগরিকদের জন্য সেবার মান উন্নত করবে।  অন্যদিকে কেউ কেউ আশঙ্কা করেন যে, এই ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন সরকারি সেবা ও কর্মীদের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবনও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এই প্রস্তাবনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি এবং বিভিন্ন মতামত ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তাই এটি বর্তমানে একটি চলমান আলোচনা এবং ভবিষ্যতে এর রূপ ও প্রভাব পরিবর্তিত হতে পারে।

ব্যবসায়িক জগতে মাস্কের প্রত্যাবর্তন

মাস্কের বিদায়ের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কেও আলোচনা বাড়ছে।  বিশেষ করে, টেসলা তার প্রথম প্রান্তিকে ৭১% মুনাফা হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে যা বাজারের অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রভাব বলে মনে করা হচ্ছে। স্পেসএক্স ও স্টারলিঙ্কেও চ্যালেঞ্জ বেড়েছে বিশেষ করে সরকারি চুক্তি ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে।

মাস্কের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও সরকারের সাথে তার সম্পর্ক ব্যবসায়িক পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা অনেক বিশ্লেষকের। অন্যদিকে তার ব্যবসায়িক দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা তাকে আবারও সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর পথ খুলে দিতে পারে।

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও ব্যবসার সমন্বয়

এলন মাস্কের মতো একজন উদ্যোক্তার জন্য ব্যবসা ও রাজনীতি আলাদা রাখা সহজ নয়। তার কোম্পানিগুলো যেমন সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল, তেমনি তার রাজনৈতিক অবস্থান, কর্মকাণ্ড, বাজার ও জনমতে প্রভাব ফেলে। মাস্কের ওয়াশিংটন সফর এই দ্বৈত ভূমিকাকে আরও স্পষ্ট করেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মাস্কের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে কীভাবে ব্যবসার ওপর নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে তার প্রযুক্তিগত ও উদ্ভাবনী লক্ষ্যগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া। একই সঙ্গে, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

প্রযুক্তি, ব্যবসা ও সরকারের সম্পর্ক: ভবিষ্যতের চিত্র

মাস্কের এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক জগতে সরকারের ভূমিকার ওপর নতুন প্রশ্ন তোলে।  ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি নীতিমালা, নিয়ন্ত্রণ, ও আর্থিক নীতির ওপর কতটুকু নির্ভর করবে তা এখন আলোচনার বিষয়। মাস্কের মতো উদ্যোক্তারা কীভাবে সরকারের সাথে সমঝোতা করে তাদের উদ্ভাবন ও ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেটাই আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ।

এলন মাস্কের ওয়াশিংটন থেকে পদত্যাগ এবং ব্যবসায়িক জগতে প্রত্যাবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। সরকারের প্রতি এ পদক্ষেপ তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক কৌশল এবং মার্কেট পরিস্থিতির প্রতিফলন। সময়ই বলে দেবে তার এই সিদ্ধান্ত কতটা সফল ও ফলপ্রসূ হবে।

তবে এটা স্পষ্ট যে, এলন মাস্ক একাধারে রাজনীতির ময়দানে ও ব্যবসার দুনিয়ায় পাকা খেলোয়াড় এবং তার কার্যকলাপ ভবিষ্যতে বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে নিশ্চিত প্রভাব ফেলবে। মাস্কের প্রত্যাবর্তন হয়তো ব্যবসা, সরকার এবং প্রযুক্তির সমন্বয়কে বিশ্ব অর্থনীতির নতুন রূপরেখা গড়ে দিতে পারে।

খবর: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম