রবিবার – ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ –  ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রবিবার – ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ –  ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাতারবাড়ী প্রকল্পে দুর্নীতির কালো মেঘ: জাইকার ঋণ স্থগিতের শঙ্কা

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ জাপানের অর্থায়নে এগিয়ে চলছিল। তবে এর সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ ওঠায় এই মেগা প্রকল্পে জাপানি ঋণ পাওয়ার বিষয়টি এখন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) দুর্নীতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে। আগামী ৪ জুনের মধ্যে এই চিঠির জবাব সন্তোষজনক না হলে প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জাইকার কড়া চিঠি ও সাতটি প্রশ্ন

জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত দুর্নীতির প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। জাইকার বাংলাদেশ প্রধান ইচিগুচি তোমোহিদে স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পে আসলে কী ঘটেছিল, তা জানার আইনি অধিকার জাইকার রয়েছে। নির্দিষ্টভাবে সাতটি প্রশ্নের উত্তর ৪ জুনের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে:

১. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কি আসলেই সাবেক প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে?

২. জাহাঙ্গীর আলম সংযোগ সড়ক প্রকল্পে ঠিক কোন সময় থেকে কোন সময় পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন?

৩. তার নামে থাকা অবৈধ সম্পদের মধ্যে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কোনো সম্পদ রয়েছে কি না?

৪. তার বিরুদ্ধে যে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে, সেখানে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কোনো লেনদেন আছে কি?

৫. দুদকের মামলা করার অর্থ কি তদন্ত শেষ, বিচার শুরু, নাকি তদন্ত এখনো চলমান?

৬. দুদক আইনের ধারা ২৭(২) অনুযায়ী, জাহাঙ্গীর আলম যদি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে আদালত কি তাকে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করবেন?

৭. অর্থ পাচারের মামলাটির বিচার কি বিশেষ কোনো বিচারক দ্বারা পরিচালিত হবে?

দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে সাবেক পিডি জাহাঙ্গীর আলম

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৫ সালে নেওয়া হয়, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে জাইকার ঋণ ৭৯১ কোটি টাকা। এই সড়ক প্রকল্পের সাবেক পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধেই উঠেছে দুর্নীতির মূল অভিযোগ। তিনি ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক পদে ছিলেন। গত ১৩ মে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে ২৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৯৪টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে মামলা করে। মামলার পরপরই তাকে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে কার্যত কাজবিহীন ‘রিজার্ভ পোস্টিং’ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আদালত জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী জানিয়েছেন, জাইকার চিঠির জবাব নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই দেওয়া হবে। তবে এরপর জাইকা অর্থায়ন অব্যাহত রাখবে কি না, সেটি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে, সাবেক ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম মনে করেন, যেহেতু সরকার নিজেই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাই প্রকল্পে অর্থায়ন পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

মাতারবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি ২০১৩ সালে নেওয়া হয়, যার মোট ব্যয় প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ সহায়তার পরিমাণ প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশে জাপানের একক বৃহত্তম ঋণ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং দ্বিতীয় ইউনিট চলতি বছরের আগস্টে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সংযোগ সড়কের কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর চাপ

জাইকার এই পদক্ষেপের পেছনে জাপানের তিনটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) চাপও রয়েছে। জাপান সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি (জেএসিএসইএস), ফ্রেন্ডস ফর আর্থ ও মেকং ওয়াচ একটি যৌথ বিবৃতি জাইকার প্রতিনিধির মাধ্যমে ইআরডি সচিবকে দিয়েছে। বিবৃতিতে তারা এই প্রকল্পে ঋণছাড় অবিলম্বে বন্ধ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত বাংলাদেশের আদালতে মামলার চূড়ান্ত রায় হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

তারা আরও উল্লেখ করেছে, জাইকার নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রকল্পে আইনি লঙ্ঘন বা অনিয়ম হলে ঋণ স্থগিত বা আগাম অর্থ ফেরতের দাবি জানানো সম্ভব। বিবৃতিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লবণ ও চিংড়ি চাষের মাধ্যমে জীবিকা হারানো এবং ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে বিলম্বের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগের কথাও তুলে ধরা হয়েছে, যা প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার চিত্রকে আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে বলে তারা মনে করে।

এই পরিস্থিতিতে মাতারবাড়ী প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এবং জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারত্বের ওপর একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি হয়েছে। সরকারের দ্রুত ও স্বচ্ছ পদক্ষেপই এই অনিশ্চয়তা কাটাতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।