উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং রাজস্ব ঘাটতির চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য একটি সাশ্রয়ী-জনমুখী বাজেট পেশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ব্যয়ের কাঠামো কিছুটা সংকুচিত হলেও সামাজিক নিরাপত্তা ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির বিস্তারে রয়েছে ইতিবাচক বার্তা। একইসাথে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কর কাঠামোতে পরিবর্তন, ব্যয়ের পুনর্বিন্যাস এবং ঋণের ওপর নির্ভরতার বাড়তি ছাপ স্পষ্ট। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই বাজেট বাস্তবতা মোকাবেলায় কতটা কার্যকর হবে, নাকি এটি হয়ে উঠবে আরেকটি ভারসাম্যহীন প্রত্যয়পত্র?
সংসদ না থাকায় সোমবার (২ জুন) বিকেলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে বাজেট বক্তব্য দেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। পরে রাতেই ‘অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।যেখানে বলা হয়েছে, প্রয়োজন হলে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে চলতি মাসের শেষে অধ্যাদেশ সংশোধন করা হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ বা আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় টাকার অংকে বাজেটের আকার কমছে ৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া ‘প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি’ পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে লক্ষ্যপূরণে অনেক দূর এগিয়েছে এবং অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
তবে অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেট বক্তৃতার এই আশাবাদের প্রতিফলন বাজেটের বিস্তারিত প্রস্তাবে দেখা যায়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই প্রথম বাজেট বিগত দেড় দশকের ঋণ-নির্ভরতার ধারা থেকে বের হতে পারেনি। এ বাজেটে জনগণকে তুষ্ট করার বেশ কিছু উদ্যোগ রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে। তবে এসব উদ্যোগ থেকে জনগণ শেষ পর্যন্তু বাস্তবে কতটুকু সুফল পাবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যাপার থাকলেও একইসঙ্গে ব্যবসার উপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন কিছু ধারার প্রতি উদ্বেগও প্রকাশ করেছে দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন, বাজেট ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগের বাধা কাটানোর জন্য বাজেটে কোনো বার্তা নেই।
বাজেটে সুদ: ঋণনির্ভরতার ধারাবাহিকতা নাকি হিসেবি ভারসাম্য
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এক লাখ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা। তাই বাজেটে দেশের ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা আরও বাড়ার ইঙ্গিত মিলেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই বাজেট বিগত দেড় দশকের ঋণনির্ভরতার ধারা থেকে বের হতে পারেনি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ শিরোনামের এই বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দৃশ্যমান কোনো নতুন কৌশল না থাকায় এবং ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ও বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ায় এর বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি’ অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারের ঘাড়ে প্রায় ২০ লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে, যা আগামী অর্থবছরের মধ্যে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে বাজেটের আকার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়ানো হলেও তা ছিল মূলত ঋণনির্ভর। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এবং মৌলিক সংস্কারের পদক্ষেপ অনুপস্থিত থাকায় এটিকে ‘গতানুগতিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকে।
করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানো: সিদ্ধান্ত ও প্রতিক্রিয়া
বাজেটে ব্যক্তিগত করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমান সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা গত কয়েক বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। এই সিদ্ধান্তে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখা সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে সহায়ক হতে পারে। তারা যুক্তি দেন, করমুক্ত সীমা বাড়ালে রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
অন্যদিকে, অনেক বিশ্লেষক এই সিদ্ধান্তকে সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি চাপ হিসেবে দেখছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকায় উন্নীত করার সুপারিশ করেছে। তাদের মতে, চলমান মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে করমুক্ত সীমা বাড়ানো প্রয়োজনীয় ছিল। তবে অনেকে বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম যথেষ্ট নয়, তাই করমুক্ত সীমা বাড়ানো জরুরি।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি: লক্ষ্য ও বাস্তবতা
আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে গত এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, ৯-১০ শতাংশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, সীমিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি আশা করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার এবার কিছু স্বস্তি দেবে কিন্তু বাজেটে সেই আশায় গুড়েবালি পড়েছে। তিনি মনে করেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে করহার বাড়ানো হলেও কর ফাঁকি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বিনিয়োগ স্থবির, আর মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে অর্থনৈতিক পরিবেশ দরকার, তার কোনো প্রস্তুতি বাজেটে নেই।
অবশ্যই অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট তৈরি হয়েছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি রোধে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এজন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত বাজেটে নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ: কতটা যৌক্তিক
প্রতি বছর বাজেট এলে কালো টাকা সাদা করা নিয়ে আলাপ-আলোচনা দেখা যায়। শুরুতে সুযোগ না দেওয়ার হুমকি-ধমকি থাকলেও কেন জানি শেষ মুহূর্তে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়ে যায়। এটা গত কয়েক দশকেরই নিয়মিত চিত্র। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ফ্ল্যাট কেনায় অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। একই সঙ্গে ভবনের নির্মাণে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। টিআইবির মতে, এই সিদ্ধান্ত অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যে-ভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র সংস্কার—বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একইসঙ্গে, দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।’ এরপর বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি সমালোচনার মুখে সরকার এ সুযোগ বাতিলের চিন্তাভাবনা করছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হলেও তাতে রাষ্ট্রের আহামরি কোনো লাভ হয় না। উল্টো নব্য কোটিপতিরা কিছু সুবিধা নিতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে এবং এ সুযোগ বাদ দেওয়ার জন্য চাপ রয়েছে। বিষয়টি হয়তো বাদ দেওয়া হতে পারে সংশোধিত বাজেটে। তবে এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা পাননি তারা।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিতে কম বরাদ্দ: চলছে সমালোচনা
বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের প্রায় ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের বাজেটের চেয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭২ শতাংশ। বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বা ০ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। নতুন অর্থবছরে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্যনিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ৭ শতাংশ বরাদ্দ বেড়েছে, যার পরিমাণ ২ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু এ তিন খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলছেন অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষকরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে কম বরাদ্দকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এই তিনটি খাতে বরাবরের মতো বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছিল, বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে কৃষি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরো বলেন, ‘১৫টি বড় খাতের মধ্যে ১৪টিতেই বরাদ্দ কমানো হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন ও মানবসম্পদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সিপিডি আরও জানিয়েছে, বাজেটের আকার তুলনামূলকভাবে সামান্য কমলেও এটিকে খুব ছোট বলা যাবে না।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: প্রশংসা ও সমালোচনার মিশ্র সুর
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেটকে কেউ বলছেন, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতির ঘাটতি। কেউ বলছেন, এটি অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক। আবার কেউ বলছেন, এতে অর্থনৈতিক বৈপ্লবিক চিন্তার অভাব রয়েছে। এছাড়া আয় বৈষম্য, কালোটাকা, কর্মসংস্থান ও বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতি নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।বাজেট ঘোষণার দুই দিনের মাথায় এক আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বলেছে, রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত নিলে বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হতো না বলে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
বাজেটের ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সেদিন রাতেই গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাছুম। এতে বলা হয়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম বাজেটে নতুন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি। আরও বলা হয়, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ এবং অন্যান্য অবৈধ অর্থ উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনার স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা প্রস্তাবিত বাজেটে লক্ষ করা যায়নি, যা জাতিকে হতাশ করবে। এ ছাড়া কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ অপচেষ্টা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বাজেট প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের যে আকাঙ্ক্ষার কথা আমরা বলেছি, এ বাজেটের মধ্যে তার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি। আগের অর্থনীতির কাঠামোর অনেক ছাপ এ বাজেটের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল ধনী-গরিবের আয় বৈষম্য কমে আসবে। কিন্তু এ বাজেটে আয় বৈষম্য কমানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখিনি।
এদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও (সিপিবি) একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এই বাজেট অর্থনীতির গতি মন্থর করবে। সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক রূহিন হোসেন প্রিন্সের যৌথ বিবৃতিতে দলটি প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক এবং সাহসী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব বলে বর্ণনা করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের পতনের পর এটি একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বাজেট, তাই আমরা কাঠামোগত পরিবর্তনের আশা করিনি। তবে অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারত। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অপর্যাপ্ত মনোযোগের কারণে সরকারের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলেও তারা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
সব মিলিয়ে, এবারের বাজেট যেমন নাগরিক জীবনের চাহিদা মেটাতে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছে, তেমনি বিনিয়োগ পরিবেশ ও ব্যবসাবান্ধব কাঠামো তৈরিতে কিছু প্রশ্নও রেখে গেছে। সাশ্রয়ী ও সাহসী এই বাজেটের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারের আন্তরিকতা, প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং নীতিগত ধারাবাহিকতার ওপর। জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে যদি ঘাটতি মোকাবেলা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগের গতি পুনরুদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যায়—তবে এ বাজেট হতে পারে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়।