গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ধুঁকতে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে আরও করের বোঝা চাপানো হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ এবং রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার শুল্ক কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার আনতে যাচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় শিল্পখাত এতদিন পেয়ে আসা বাড়তি সুরক্ষা হারাতে পারে, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও উসকে দেবে। আগামী ২ জুন, সোমবার, জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে নতুন অর্থবছরের এই বাজেট উপস্থাপন করা হবে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ৫০০ ধরনের পণ্যের ওপর আরোপিত ২০ থেকে ৪০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) কমানো বা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হতে পারে। তবে, স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষামূলক সুবিধা কমানোর অংশ হিসেবে অন্তত ১৪টি খাতের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর মধ্যে বেভারেজ, এলইডি বাল্ব, ওয়াটার পিউরিফায়ার, ফ্যান, সিগারেটের কাগজ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের কাঁচামাল এবং শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টি উপকরণ উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে, নির্মাণ শিল্পের মূল উপকরণ যেমন সিমেন্টের ক্লিংকার, রড, বার, অ্যাঙ্গেল, টাইলস, স্ক্রু, নাট-বোল্ট এবং মার্বেল-গ্রানাইটের ওপর শুল্ক ও করভার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন ধরনের স্ক্রু, নাট ও বোল্টের মোট করভার ৩৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯.৩২ শতাংশ এবং মার্বেল ও গ্রানাইটের ক্ষেত্রে ৮৯.৩২ শতাংশ থেকে ১২৭.৭২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকারের ওপর নির্ধারিত শুল্কের পরিবর্তে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ হারে বাজারমূল্যে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে।
এছাড়াও, প্রসাধনী সামগ্রী (লিপস্টিক, ফেস পাউডার, ফেসওয়াশ), দরজার তালা, খেলনাসহ ২১ ধরনের পণ্যের ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে, যার ফলে আমদানিকারকদের নির্ধারিত উচ্চমূল্যের ওপর কর পরিশোধ করতে হবে। তামাক বীজ ও সয়াবিন মিলের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ এবং রেফারেল হাসপাতালের জন্য আমদানিকৃত চিকিৎসা সরঞ্জামের শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবও রয়েছে। কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিজ আমদানিতে বিদ্যমান কর রেয়াত বাতিলের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও আগের সরকারের মতোই জনগণের ওপর করের হার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করছে। আইএমএফের চাপও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এতে স্থানীয় শিল্প চাপে পড়বে, কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। মানুষের আয় না বাড়লেও খরচের বোঝা বেড়েই চলেছে।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ১৭২টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখতে ১৩৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে। তবে এর ফলে আমদানিনির্ভরতা বাড়তে পারে এবং দেশীয় শিল্প অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য, পিভিসি পাইপ ও কপার ওয়্যারের মতো কিছু শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাবও রয়েছে, যা স্থানীয় উৎপাদনে সহায়ক হতে পারে। কোল্ড স্টোরেজের যন্ত্রপাতি আমদানিতেও রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
শুল্ক কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আমদানি শুল্কের বিদ্যমান ছয়টি স্তরের (০, ১, ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ শতাংশ) পরিবর্তে সাতটি স্তর (০, ১, ৩, ৫, ১০, ১৫ ও ২৫ শতাংশ) এবং সম্পূরক শুল্কের বিদ্যমান ১২টি স্তরের পরিবর্তে ১৩টি স্তর করা হতে পারে।
এইসব পরিবর্তনকে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে শুল্ক কাঠামোর ‘যৌক্তিকীকরণ’ এবং স্থানীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সুরক্ষা না দিয়ে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তবে এর ফলে সার্বিকভাবে দাম বাড়ার এবং স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমার উদ্বেগও প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।